কোরআন-হাদিসের আলোকে ফেরেশতা পরিচিতি
ফেরেশতা যার আরবি প্রতিশব্দ ملاءكة এবং ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘অ্যান্জেল’। ইসলামের আকিদা অনুসারে স্বর্গীয় দূত। আরবিতে ফেরেশতাদের একবচনে মালাইক ও বহুবচনে মালাক বলে। তাদের সম্পর্কে বলা হয়, তারা মানুষ ও অন্যন্য প্রাণীকূলের ন্যায় মহান আল্লাহর আরেক সৃষ্টি। তারা দিনরাত ক্লান্ত না হয়ে মহান আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা করেন এবং মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহর অবাধ্য হবার কোনো ক্ষমতা তাদের নেই। এরা মহান আল্লাহর নির্দেশ পালনে সর্বদা রত থাকেন। ফেরেশতারা অদৃশ্য জগৎ।
পবিত্র কোরআনুল কারিমে রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের সম্পর্কে বলেন, ‘তারা আল্লাহ তাআলা যা আদেশ করেন, তা অমান্য করে না এবং যা করতে আদেশ করা হয়, তাই করে’। (সূরা: তাহরিম, আয়াত: ৬)
তারা শুধু মাত্র মহান আল্লাহ তাআলার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি এবং যেকোনো প্রকার পাপ, হিংসা, লোভ-লালসা, ঘুম যাবতীয় কিছু তাদের স্পর্শ করতে পারে না।
ফেরেশতারা নূর তথা আলোর তৈরি। তারা খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করেন না। তারা পবিত্র স্থানে অবস্থান করেন। তারা যেকোনো স্থানে গমনাগমন ও আকৃতি পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখেন। ইসলাম, খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্ম ছাড়া হিন্দু ধর্মসহ অন্যন্য ধর্মেও ফেরেশতাদের তথা স্বর্গীয় দূতদের অস্তিত্ত্বের কথা বলা হয়েছে
ফেরেশতাদের গঠন ও আকৃতি
ফেরেশতারা নূরের তৈরি। ফেরেশতাদের মাঝে লিঙ্গ বৈষম নেই। তারা নারীও নয় আবার পুরুষও নয়। মক্কার মুশরিকরা ফেরেশতাদেরকে মহান আল্লাহর কন্যা বলে বিশ্বাস করতো। সে প্রসঙ্গে মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনুল কারিমে বলেন, ‘তোমাদের পালনকর্তা কি তোমাদের জন্যে পুত্র সন্তান নির্ধারিত করেছেন এবং নিজের জন্যে ফেরেশতাদেরকে কন্যারূপে গ্রহণ করেছেন? নিশ্চয় তোমরা গুরুতর গর্হিত কথাবার্তা বলছো’। (সূরা: আল-ইসরা, আয়াত: ৪০)
ফেরেশতাদের প্রকৃত গঠনগত রুপ কেমন তা একমাত্র মহান আল্লাহ তাআলাই জানেন। তবে তারা মানুষের আকৃতি ধারণ করতে সক্ষম। সুতরাং হজরত জিবরাইল (আ.) ছেলেও নন আবার মেয়েও নন। দৈহিক গঠনগত দিক থেকে তিনি লুকায়িত এবং অজ্ঞাত। এতটুকু জানা যায় যে তিনি নূরের দ্বারা তৈরি। অতএব, হজরত জিবরাইল (আ.) দেখতে কেমন তা সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। যতদূর জানা যায় হজরত জিবরাইল (আ.) এর ৬৫০টি পাখা আছে।
আবার রাসূলুল্লাহ (সা.) এর যখন সিনাহ পবিত্র করা হয়েছিল তখন হজরত জিবরাইল (আ.) সাদা কাপড় পড়া মানুষের আকৃতি ধারণ করেছিলেন। যখন রাসূল (সা.) এর নিকট ওহি নিয়ে আসতেন তখন বেশির ভাগই দাইয়াতু কাবলি (রা.) এর রুপ ধারণ করে আসতেন | সুতরাং বলা যায় ফেরেস্তাদের নির্দিষ্ট রুপ নেই মহান আল্লাহ তাআলা যখন যে রুপ ধারণ করতে বলেন তারা তখন সেই রুপই ধারণ করেন।
প্রধান ৪ ফেরেশতার পরিচিতি
ফেরেশতাদের মধ্যে ৪ জন প্রধান ফেরেশতা আছেন যারা মহান আল্লাহ পাকের আদেশে বিশেষ বিশেষ কাজে নিবিষ্ট আছেন। ফেরেশতা চারজন হলেন-
(১) হজরত জিবরাঈল (আ.): ৪ জনের প্রথম জন হলেন হজরত জিবরাঈল (আ.)। তাকে সব ফেরেশতাদের সরদার বলা হয় এবং তিনি ওহি নাজিল করার দায়িত্বে ছিল।
(২) হজরত ইসরাফিল (আ.): ৪ জনের দ্বিতীয় জন হলেন হজরত ইসরাফিল (আ.)। তার দায়িত্ব মহান আল্লাহর নির্দেশক্রমে কেয়ামতের দিন শিংগায় ফুৎকার দেওয়া। হজরত ইসরাফিল (আ.) এর শিংগায় ফুৎকার দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেয়ামত সংঘটিত হবে।
(৩) হজরত মিকাঈল (আ.): ৪ জনের তৃতীয় জন হলেন হজরত মিকাঈল (আ.)। তার কাজ হচ্ছে বৃষ্টি বর্ষণ, উদ্ভিদ উৎপাদন প্রভৃতি কাজে নিয়োজিত। এছাড়াও বজ্রপাত ঘটানোর কাজও হজরত মিকাঈল (আ.) এর হাতে।
(৪) হজরত আজরাঈল (আ.): ৪ জনের সর্বশেষ অর্থাৎ ৪র্থ জনের নাম হজরত আজরাঈল (আ.)। যিনি মালাকুল মওত নামেও পরিচিত। মহান আল্লাহ পাকের আদেশে প্রাণীকুলের জান কবজের কাজে তিনি নিয়োজিত।
এই ৪ ফেরেস্তা ব্যতীত সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ তাআলা অগণিত ফেরেশতা সৃষ্টি করেছেন। তাদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনো কাজে দায়িত্বরত রয়েছেন কিন্তু তাদের মধ্যে যাদের কথা সচরাচর আলোচনা হয়ে থাকে তারা হলেন-
(১) হামালাত আল-আরশ বা যেসমস্ত ফেরেশতা মহান আল্লাহর আরশ ধরে রাখে, মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনুল মাজিদে বলেন যে, ‘(কেয়ামতের দিন) ফেরেশতারা আকাশের প্রান্তদেশে থাকবে। সেদিন ৮ জন ফেরেশতা তোমার রবের আরশকে ধারণ করবে তাদের ঊর্ধ্বে’। (সূরা: হাক্কাহ, আয়াত: ১৭)
(২) ৭টি বেহেশতের ফেরেশতাগণ, (৩) হাফাজা বা তত্ত্বাবধায়ক ফেরেশতাগণ (৪) মুনকার ও নাকীর: কবরে প্রশ্নকারী ফেরেশতাদ্বয়, (৫) দারদায়িল, (৬) মালিক: জাহান্নাম বা নরক তত্ত্বাবধানকারী ফেরেশতা,
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন, ‘মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই আগুন থেকে রক্ষা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যাতে নিয়োজিত আছে পাষাণ হৃদয়, কঠোরস্বভাব ফেরেশতাগণ। আল্লাহ তাআলা তাদের যা আদেশ করেন, তারা তা অমান্য করেন না এবং যা করতে আদেশ করা হয়, তাই করে’। (সূরা: তাহরিম, আয়াত: ৬)
(৭) রিজওয়ান: জান্নাত বা স্বর্গ তত্ত্বাবধানকারী ফেরেশতা, (৮) নিয়ম শৃঙ্খলা পালনকারী ফেরেশতাগণ, (৯) এছাড়াও বিশেষ ২ জন ফেরেশতা কিরামুন ও কাতিবীন প্রতিজন মানুষের ভালো-মন্দ কাজের হিসাব রাখেন।
কোরআন মাজিদে বলা আছে, ‘স্মরণ করুন! ২ ফেরেশতা ডানে ও বামে বসে তার আমল গ্রহণ করে। সে যে কথাই উচ্চারণ করে, তাই গ্রহণ করার জন্যে তার কাছে সদা প্রস্তুত প্রহরী রয়েছে’। (সূরা: কাফ, আয়াত: ১৭-১৮)
সবশেষে বলা যায়, ফেরেশতাদের মাধ্যমেই মহান আল্লাহ তাআলা নবী-রাসূলগণের নিকট আসমানি কিতাব ও প্রত্যাদেশ প্রেরণ করেছেন। পবিত্র কোরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘ফেরেশতাদের অস্তিত্ব রয়েছে, তারা আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি এবং তার নিয়ন্ত্রণাধীন ও পরিচালনাধীন। ‘তারা তার আগ বাড়িয়ে কোনো কথা বলে না, তার নির্দেশেই তারা কাজ করে যায়’। (সূরা: আম্বিয়া, আয়াত: ২৬-২৭)
মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলা বান্দার আমলনামা লিখার কাজেও ফেরেশতাদের নিযুক্ত করেছেন। রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের ওপর নিযুক্ত রয়েছে তত্ত্বাবধায়করা (ফেরেশতারা), যারা সম্মানিত লেখক। তারা তোমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবগত’। (সূরা: ইনফিতার, আয়াত: ১০-১২)
ফেরেশতারাই রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রতি পঠিত দরূদ ও সালাম তার নিকট পৌছান। ফেরেশতার মাধ্যমেই বান্দার মৃত্যুর সময় রুহ কবজ করান। দুনিয়াতে প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে বৃষ্টি বর্ষণ করান ফেরেশতাদের মাধ্যমে। দুনিয়াতে মুমিন বান্দার জন্য মাগফিরাত কামনায় তিনি ফেরেশতা নিযুক্ত করে রেখেছেন। সর্বোপরি মহান আল্লাহ তাআলা এ ফেরেশতার শিঙ্গায় ফুৎকারের মাধ্যমে পৃথিবীতে কেয়ামত (মহাপ্রলয়) ঘটাবেন আবার কিয়ামত পরবর্তী পুনরুত্থান ঘটাবেন।
হাশরের ময়দানে এ ফেরেশতাদের মাধ্যমেই মহান আল্লাহ তাআলা বান্দার ভালো ও মন্দ কাজের সাক্ষ্য নেবেন। আর তাই মহান আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকে ঈমানের অংশ নির্ধারণ করেছেন। যা পবিত্র কোরআন এবং হাদিসে সুস্পষ্টভাষায় বর্ণিত রয়েছে। তাই ফেরেশতারা মহান আল্লাহর অনুগত সৃষ্টি অন্তরে এ বিশ্বাস রাখা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর আবশ্যক কর্তব্য।
মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে তার আনুগত্যে তাদের অবস্থানের নমুনা পবিত্র কোরআনের বিধান পালনে নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
সূত্র: ডেইলি বাংলাদেশ